বিশ্বের অন্যান্য ক্রিকেট ক্লাবগুলোর স্বাভাবিক ধারার কোন ক্লাব নয় লন্ডনের গ্রেস ক্রিকেট ক্লাব। বিভিন্ন দেশের বিচ্ছিন্ন সব নাগরিকদের নিয়ে গড়া এই ক্রিকেট ক্লাব। এখানে রয়েছেন ভারতীয়, পাকিস্তানি, একজন বাংলাদেশি, একজন নিউজিল্যান্ড, একজন অস্ট্রেলিয়ান ও বেশ কয়েকজন যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের নিয়ে চলছে এই ক্রিকেট ক্লাব। তবে এই ক্লাবের সবচেয়ে অনন্য ব্যাপার হচ্ছে এটি আর আট-দশটি ক্রিকেট ক্লাবের মতো নয়, বরং বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র সমকামী ক্রিকেট ক্লাব এটি।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ক্রিকেটার ডব্লিউ জি গ্রেসের নামের সাথে মিল রেখে করা হয়েছে এই ক্লাবের নামকরণ। ১৯৯৭ সালে কিং ক্রস রেল স্টেশনের বাইরে সেন্ট্রাল স্টেশন নামক একটি মদের বার থেকে আলোচনা শুরু হয় সমকামীদের নিয়ে ক্রিকেট ক্লাব গড়ার ব্যাপারে। যেখানে তারা ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি আলোচনা করেন সমকামীদের অধিকার, তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও নারী-পুরুষের মতো করেই বেঁচে থাকার দাবীর ব্যাপারে।
সেন্ট্রাল স্টেশন নামক মদের দোকানের মালিক ডানকান ও জোনাথন হার্ডিস্টি নামক এক ব্যক্তির হাত ধরে পথচলা শুরু গ্রেস ক্রিকেট ক্লাবের। সমকামী সম্প্রদায়ে বেশ জনপ্রিয় ডানকান ও জোনাথান একটি গোলাপি কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় যে ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে আগ্রহী সমকামীরা যাতে তাদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা অবাক হয়ে যান যখন তারা দেখেন যে তাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি মানুষ এসেছে ক্রিকেট খেলার লক্ষ্যে।
এ ক্লাবে যিনি বাংলাদেশি আছেন, কয়েক মাসেই আগে একজন মহিলার সাথে তার বিয়ে হয়। কিন্তু সে ব্যক্তি সমকামীতায় আগ্রহী থাকায় চলে আসেন গ্রেস ক্রিকেট ক্লাবে। সে ব্যক্তির পরিচয় না জানা গেলেও তার ব্যাপারে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জোনাথন বলেন, ‘আমি জানিনা কিভাবে তার বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত হয়েছে বা হবে। এটা অবশ্যই সেই মহিলার প্রতি জুলুম হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে পারিবারিক চাপের কারণেই তিনি এমনটা করতে রাজি হয়েছেন। এটা বলতে বাধ্য হই যে মূলত পরিবারের কারণে একজন সমকামীর বেঁচে থাকাটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।’
এই দলের পাকিস্তানি নাগরিক বেশ কিছুদিন বাস্তুহারা জীবনযাপন করেন পাকিস্তানে। পরে জোনাথনের সাথে দেখা হলে বদলে যায় তার জীবন। জোনাথান তাকে রাস্তা থেকে নিয়ে আসেন দলে। দলের বাকি সবার সাথে মিশে সেই পাকিস্তানি নাগরিক যেন পেয়ে যান নতুন এক জগত। যেখানে রয়েছে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, ভালো থাকার ক্রিকেট। কিন্তু তবুও তিনি রেহাই পাননি সমাজের হাত থেকে। এখনো তাকে দ্বৈত জীবনযাপন করতে হয়।
দলের খুব বেশি সদস্যের ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি প্রতিষ্ঠাতা জোনাথন। এমনকি দলের ছবি বা ম্যাচের স্কোরকার্ডেও উল্লেখ করা হয় না সবার পুরো নামটা। তবে কোন স্বাভাবিক দলের বিপক্ষে খেলতে গেলে কখনো নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়নি বলে জানান জোনাথন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পথচলার সেরা ব্যাপারটা আমরা কখনো প্রতিপক্ষ দলের কাছ থেকে কোন নেতিবাচক বা সমকামী বিরোধী মন্তব্য শুনিনি।’
ব্যক্তিগত জীবনে ১৪ বছরের এক কন্যা সন্তানের পিতা জোনাথন। তিনি চাইছেন তার মেয়েকেও এই ক্লাবে অন্তর্ভুক্ত করতে। তিনি নিজে ৩০ বছর বয়সে সমকামীতার ব্যাপারে সোচ্চার হলেও তার ছোট্ট মেয়ের এ বয়সেই সচেতন হতে দেখে বিমুগ্ধই হয়েছেন জোনাথন। সাউদাম্পটনের অদূরে পোর্টসমাউথের এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা জোনাথনের। স্কুলে থাকতে ছেলেদের কাছ থেকে বারবার বিরূপ আচরণের শিকার হতে হয়েছে তাকে। যে কারণে বন্ধু বানানোর বদলে খেলাধুলার দিকে ঝোঁক আসে জোনাথনের।
‘সকলের মধ্যে একটা বদ্ধ ধারণা রয়েছে যে সমকামী মানুষেরা হয়তো ক্রীড়াপ্রেমী হয় না। এ কারণে তারা প্রথম প্রথম আমার সমকামীতার ব্যাপারটি ধরতে পারতো না। কারণ আমি সবধরনের খেলায় পারদর্শী ছিলাম। সৌভাগ্যবশত আমি আমার মায়ের কাছ থেকে দারুণ সহযোগিতা পেয়েছিলাম। যুক্তরাজ্যে এটি কল্পনা করাও মুশকিল’
তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি বদলেছে অনেক। সমকামীতা বৈধতা পেয়েছে অনেক দেশে। যে কারণে গ্রেস ক্রিকেট ক্লাবের পাকিস্তানিরা এখন আগের চেয়ে আরও স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছে বলে জানান জোনাথন। এছাড়াও বৈধতা পাওয়ার পর থেকে বাইরের দলগুলোর সাথেও আগের চেয়ে অনেক বেশি আমন্ত্রণমূলক ম্যাচ খেলতে পারছে গ্রেস ক্রিকেট ক্লাব।
বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র এই সমকামী ক্রিকেট ক্লাবের ব্যাপারে আরও জানতে চাইলে ভিজিট করতে পারেন তাদের ওয়েবসাইট: www.gracescricket.org.uk